জাতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য


জাতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

  জাতির সংজ্ঞা  

 ' জাতি ' কথাটির নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া শক্ত কাজ বৈকি ! 

জাতি হল একটি বদ্ধগোষ্ঠী । এটি একটি অন্তর্বৈবাহিক গোষ্ঠী এবং এর বংশানুক্রমিকতা আছে । 


 জাতিপ্রথা হল এক সর্বভারতীয় ব্যবস্থা বিশেষ । কেননা জাতির অভ্যন্তরে সকলেরই স্থান জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয় এক্ষেত্রে তিনি ' কর্মের ধারণা ' এবং ' ধর্মের ধারণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।

 জাতি হল একটি নির্দিষ্ট নামে চিহ্নিত ক্ষুদ্রাকার জনগোষ্ঠী যার সদস্যরা অন্তর্বিবাহ রীতি , বংশগত সদস্যপদ এবং একটি সুনির্দিষ্ট জীবনশৈলী অনুসরণ করে চলে , যেটি একটি নির্দিষ্ট পেশার সঙ্গে যুক্ত , ক্রমোচ্চ বিভাজিত এবং স্বতন্ত্র ধর্মীয় পদমর্যাদা ভিত্তিক হয় । এর পেছনে পবিত্রতা অপবিত্রতা বিশেষভাবে সম্পর্কিত থাকে ।

 Caste কথাটির মানে হল জাত ( Zat ) , আবার কখনও Biradai বা Bhaiband কথাটিও ব্যবহার করা হয় । উপজাতি বা Sub - caste বোঝানোর নির্দিষ্ট কোন শব্দ নেই । Nika ( origin ) bens বা mul ( stock ) , al kul ( family ) —– এই বিভিন্ন শব্দগুলি জাতি বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও সবসময় বিভিন্ন উপভাগগুলির মধ্যে একই অর্থ  বোঝায় না । 


    জাতির বৈশিষ্ট্য ( Characteristics of Caste )  

 জাতির নানাবিধ ধারণার পর্যালোচনা সাপেক্ষে এর কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যায় । বৈশিষ্ট্যগুলির যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে জাতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করা সম্ভব হয় । বিশেষত ভারতীয় জাতিভেদ প্রথার জটিলতার গভীরতা উন্মোচনের জন্য এর বৈশিষ্ট্যগুলি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্রয়োজন । 

i )  বংশানুক্রমিক : জাতি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বংশানুক্রমিতা উল্লেখযোগ্য । জাতির সদস্যপদ বংশানুক্রমিকভাবে আরোপিত হয় অর্থাৎ জাতি জন্মভিত্তিক । জন্মের ভিত্তিতে আরোপিত মর্যাদা এর সদস্যরা আজীবন বহন করে চলে । ব্রাক্ষ্মণের ছেলে ব্রাক্ষ্মণ , কুমোরের ছেলে কুমোর হবে । সুতরাং বংশানুক্রমিতা জাতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য । 

ii) অন্তবৈবাহিক :  জাতিকে অন্তবৈবাহিক গোষ্ঠী হিসাবেও চিহ্নিত করা হয় । অন্তর্বিবাহ মেনে চলে এমন জনগোষ্ঠী হ’ল জাতি । এই সূত্রে কোন জাতির সদস্য অন্য জাতির সদস্যকে বিয়ে করতে পারে না । অর্থাৎ স্বজাতির মধ্যেই বিয়ে হতে হবে । 

**Youtube Channel **

iii) সপাঙক্তেয়তা :  সপাঙক্তেয়তা জাতি ব্যবস্থার আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । সাধারণত খাদ্য গ্রহণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ , যেমন জল - চল , জল - অচল প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে সকল রীতিনীতি প্রচলিত আছে তারই সংক্ষিপ্ত রূপ সম্পাক্তেয়তা । প্রতিটি জাতি তার অপরিহার্য দিক হিসাবে সপাঙ্ক্তেয়তাকে মেনে চলে । এই সূত্রে উচ্চবর্ণের মানুষ নিচু জাতির ছোঁয়া বা রান্না করা জিনিস খাবে না । মানে এগুলি করার অর্থ হল জাতিচ্যুতি । তবে জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে সপাঙক্তেয়তার নানাবিধ রীতিনীতি প্রচলিত আছে । অঞ্চলভেদে এগুলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা হয় । 

iv) বৃত্তি বিভাগ :  জাতিপ্রথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে বৃত্তি বিভাগও সবিশেষ উল্লেখ্য ।  জাতিপ্রথার মধ্যে যে সকল ভিত্তি আছে তার অন্যতম হল বৃত্তি । এক্ষেত্রে অধিকাংশ জাতিই বৃত্তিভিত্তিক , জাতি নির্দেশিকা মতে এক জাতির পেশা অন্য জাতি নিতে পারবে না । সমাজবিজ্ঞানীর মতে প্রত্যেক জাতির আলাদা আলাদা পেশা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে শ্রমবিভাগ প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল । এর পাশাপাশি বিশেষীকরণ প্রক্রিয়াও উৎপাদনগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করেছিল । এইভাবে জাতিগত বিশেষ বৃত্তি ধারণ এবং বিশেষীকরণ প্রক্রিয়ার উন্নয়ন বংশাক্রমিক পর্যায়ে অনুসৃত হয় । 

v ) বিধিবিধান :  প্রত্যেক জাতির বিধিবিধান থাকে , যা একান্ত নিজস্ব - স্বতন্ত্র । এগুলি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে জাতিগুলি অত্যন্ত সচেতন এবং যত্নশীল থাকে । জন্ম - বিয়ে - মৃত্যু ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে এগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পরস্পরাগতভাবে প্রতিপালিত হয় । এগুলি আমান্য করলে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করা হত । অধ্যাপক দুবে মনে করেন , কোন জাতি কতটা ‘ শুদ্ধ ’ বা ‘ অশুদ্ধ ’ তার ওপরেই জাতিগুলির মধ্যে সামাজিক আদান প্রদানের বিষয়টি নির্ভর করে । তাছাড়া যে জাতির অবস্থান সমাজে যত উঁচুতে , ‘ শুদ্ধতা ’ বজায় রাখার লক্ষ্যে তাদের আচার সংস্কার তত জটিল ।

vi ) সামাজিক স্তরবিন্যাসের :  সামাজিক স্তরবিন্যাসের ( Social stratification ) গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে জাতি ব্যবস্থাকে নির্দেশ করা যায় । জাতি ব্যবস্থায় বংশানুক্রমিক মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ ক্রমশ ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিন্যস্ত ( hicnanchy ) হয়ে যায় । এই উচ্চনীচ তারতম্যের সঙ্গে জাতিগত পেশার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ , পেশাগত ‘ শুদ্ধতা ’ ‘ অশুদ্ধতা ’ বিষয়টি বিশেষ করে । এর সমান্তরালে মর্যাদাটিও সম্পৃক্ত । এই বিচারে ব্রাক্ষ্মণের মর্যাদা সমাজে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী 

vii ) জীবনধারা ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্যতা :  বিভিন্ন জাতির মধ্যে জীবনধারা ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । অধ্যাপক গোবিন্দ সদাশিব ঘ্যুরে ( G. S. Ghurye ) বলেন , বৃহত্তর সমাজের অংশ হয়েও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলি তাদের নিজস্ব সামাজিক জগতের মধ্যে অনেকটাই সম্পূর্ণ । অন্তর্বৈবাহিক গোষ্ঠী হিসাবে জাতিগুলি এক একটি স্বতন্ত্র জীবনধারার মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । 

viii) জাতিভেদ প্রথায় সামাজিক সচলতার পথ রুদ্ধ :  জাতিভেদ প্রথায় সামাজিক সচলতার পথ রুদ্ধ । জন্মসূত্রে নির্ধারিত জাতিগত অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে । জাতি নির্দেশিকার বাইরে কোন কিছুতেই অমান্য করার মানেই হল জাতিচ্যুত হওয়া । মানুষের সঙ্গে জাতির সম্পর্ক অপরিবর্তিত থাকে ।  সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতিগত মর্যাদার পরিবর্তন / উন্নতি হওয়া সম্ভব । তবে জাতিগত প্রশ্নে তিনি কর্মবাদের কথা উল্লেখ করে বলেন যে , কর্মবাদের ধারণা থেকে । একজন হিন্দুকে এই শিক্ষাই দেয় যে , সে একটি বিশেষ জাতিতে জন্মগ্রহণ করেছে । কেননা ঐ জাতিতে জন্মগ্রহণের মত যোগ্যতাই তার ছিল । এই যোগ্যতা আমৃত্যু তার কৃতকর্মের ফলে অর্জিত হয়েছে ।

Post a Comment

0 Comments