প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব আলোচনা করো



প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান

 প্রাচীন ভারতীয়রা জ্ঞান - বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিলেও প্রাচীন ভারতে কিন্তু কোনও ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয় নি বা এই যুগে হেরোডোটাস , থুকিদিদিস , লিভি , ট্যাসিটাস বা পলিবিয়াসের মতো কোনও ঐতিহাসিকও ভারতে জন্মগ্রহণ করেন নি । ভারতে সর্বপ্রথম যে গ্রন্থটিকে মোটামুটি ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া যায় , তা হল কাশ্মীরি পণ্ডিত কহুন রচিত কাশ্মীরের ইতিহাস— ' রাজতরঙ্গিনী ' । এই গ্রন্থটির রচনাকাল হল দ্বাদশ শতাব্দী , যদিও ভারত ইতিহাসের সূচনা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সিন্ধু সভ্যতার যুগে । ইতিহাস গ্রন্থের অভাব ইতিহাসের উপাদান ( Sources of History ) প্রাচীন ভারতে ইতিহাস গ্রন্থের অভাব সম্পর্কে পণ্ডিতরা বিভিন্ন কারণের কথা বলেছেন ।

( ১ )প্রাচীন ভারতে বেশ কিছু ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছিল , কিন্তু কালের প্রকোপে নানা কারণে সেগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে । বলা বাহুল্য এ মত গ্রহণযোগ্য নয় , কারণ মহাকাল বেছে বেছে । কেবলমাত্র ইতিহাস গ্রন্থগুলিই ধ্বংস করল , এমনটা কখনোই হতে পারে না ।

 ( ২ ) প্রাচীনকালে ভারতীয়রা ইহলোক ও জাগতিক বিষয় সম্পর্কে উদাসীন ছিল । তাদের আগ্রহ ছিল ধর্মীয় ও পারলৌকিক বিষয় সম্পর্কে । এ জন্যই তারা জাগতিক বিষয় ইতিহাস চর্চায় উৎসাহী হয় নি । বলা বাহুল্য এ মতও গ্রহণযোগ্য নয় , কারণ কৌটিল্যের ‘ অর্থশাস্ত্র ’ , বাৎস্যায়নের ‘ কামসূত্র ’ , শুক্রচার্যের ‘ রাজনীতি ’ , চরক - সুশ্রুতের ‘ চিকিৎসাশাস্ত্র ’ বা অনুপম স্থাপত্য - ভাস্কর্যের কাজে বাধা সৃষ্টি না করে পরলোক - চিন্তা কেবলমাত্র ইতিহাস - চর্চার ক্ষেত্রেই বাধা সৃষ্টি করল — এমন বক্তব্য কখনোই যুক্তিগ্রাহ্য নয় । 

( ৩ )প্রাচীন ভারতে এমন কোনও বৃহৎ আকারের বৈদেশিক আক্রমণ ঘটে নি , যা ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ইতিহাস রচনায় ব্রতী করতে পারে । প্রাচীন গ্রিসে পারসিক আক্রমণ প্রতিরোধ কল্পে যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার উন্মেষ ঘটে , তাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে হেরোডোটাস মাতৃভূমির ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন ।

 ( ৪ )  জনশ্রুতি , উপকথা ও প্রকৃত ইতিহাসের মধ্যে ভেদাভেদ জ্ঞানের অভাব থাকায় ভারতীয়দের পক্ষে যথার্থ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয় নি । ইতিহাস গ্রন্থের অভাবের কারণ একাদশ শতকে ভারতে আগত বিখ্যাত আরব পর্যটক অল্ বিরুনি ( Alberuni ) বলেন যে , হিন্দুরা ইতিহাস রচনার প্রতি উদাসীন এবং রাজাদের কালানুক্রমিক ইতিহাস সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ । ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য চাপ দিলে তারা কল্পনা ও কিংবদন্তির আশ্রয়গ্রহণ করে । 

 প্রাচীন হিন্দুরা ইতিহাস লিখতে জানত না এবং তাদের মধ্যে ইতিহাসবোধও ছিল না ।প্রাচীন লেখকরা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করতেন । ক্ষমতাসীন রাজন্যবর্গ সভাপণ্ডিতদের মারফত তাঁদের কীর্তি কাহিনি তুলে ধরতে চাইতেন । বাণভট্টের ‘ হর্ষচরিত ’ , সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘ রামচরিত ’ , বিহুনের ' বিক্রমাঙ্কদেব চরিত ’ প্রভৃতি জীবনী গ্রন্থ থেকে ভারতীয়দের ইতিহাস - চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় । বিভিন্ন শিলালিপি ও তাম্রলিপিতে রাজন্যবর্গের কর্ম - কৃতিত্বের বিবরণ উৎকীর্ণ হত । বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যেও ঐতিহাসিক তথ্যাদি ছড়িয়ে থাকত । কালানুক্রম যে - কোনও ইতিহাসের মূলমন্ত্র । লিপিগুলিতে সন - তারিখ সহ বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে । পুরাণগুলি থেকে বিভিন্ন রাজবংশের বংশতালিকা পাওয়া যায় । খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আগত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ -এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে , প্রাচীন ভারতের প্রত্যেক প্রদেশেই ভালো - মন্দ সকল ঘটনার সময়ানুক্রমিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করার রীতি প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ভারতীয়দের মধ্যে ইতিহাস চেতনা ’ বা ‘ ইতিহাসবোধ ' - এর অভাব ছিল বা প্রাচীন ভারতে ইতিহাসের ‘ উপাদানের ’ অভাব ছিল — এ মন্তব্য যথার্থ নয় । বেদ - পুরাণ - রামায়ণ - মহাভারত - সাহিত্য - দর্শন রাজন্যবর্গের জীবনচরিত ও লিপির মধ্যে ইতিহাসের অজস্র উপাদান বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে । তাঁর মতে , ইতিহাসবোধ বা তথ্যের অভাব নয় আসলে অভাব ছিল বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে প্রকৃত সাহিত্য গুণসম্পন্ন ইতিহাস রচনার উৎসাহ ও ইচ্ছার ।

 প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে মূলত দু'ভাগে ভাগ করা যায়—

 ( ক ) সাহিত্যিক উপাদান এবং ( খ ) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ।

    সাহিত্যিক উপাদানকে আবার দু'ভাগে ভাগ করা যায় –

 ( ১ ) ভারতীয় সাহিত্য ও ( ২ ) বিদেশি সাহিত্য । 

অনুরূপে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে আবার  তিনভাগে বিভক্ত করা যায় – 

( ১ ) লিপি , ( ২ ) মুদ্রা ও ( ৩ ) স্থাপত্য - ভাস্কর্য 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব আলোচনা করো

ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্যের গুরুত্ব বিচার করুন 

 ( ক ) সাহিত্যিক উপাদান ( Literary Sources ) 

 বিভিন্ন উপাদান ভারতীয়দের ইতিহাসবোধের 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব

 ( ১ )প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে  দেশীয় সাহিত্য : প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পূর্ববর্তী যুগ বা প্রাক্ - বিম্বিসার যুগের কোনও লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না । বেদ , মহাকাব্য ও পুরাণ থেকে এই যুগের কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায় । ঋক , সাম , যজু ও অথর্ব — এই চারটি বেদ এবং সংহিতা , ব্রাহ্মণ , আরণ্যক ও উপনিষদ এবং সূত্র সাহিত্য নিয়ে বিশাল বৈদিক সাহিত্য গড়ে উঠেছে । কোনও কোনও বেদ ও বৈদিক সাহিত্য পণ্ডিত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বেদ ও বৈদিক সাহিত্যের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করলেও , এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না । ঋগ্বেদ হল বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ । এর রচনাকাল নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও মোটামুটিভাবে বলা যায় যে , ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এটি রচিত হয় । ( ঋগ্বেদ থেকে ‘ সপ্তসিন্ধু ’ অঞ্চলে আর্যদের বসতি স্থাপন এবং তাদের রাজনৈতিক , সামাজিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় । সামবেদ , যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ থেকে আর্য সংস্কৃতির নানা বিবরণ , ভারতের নানা অঞ্চলে তাদের সম্প্রসারণ এবং আর্য - অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ সম্পর্কে নানা বিবরণ পাওয়া যায় । এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে , এগুলি মূলত ধর্মগ্রন্থ — ইতিহাস নয় । ঐতিহাসিককে তাই এগুলি ব্যবহারের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে । 

প্রাচীন ভারতের  মহাকাব্য 

 বৈদিক সাহিত্যের পর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দুই মহাকাব্য — রামায়ণ ও মহাভারত । এই দুই মহাকাব্যের মধ্যে কোনটি আগে এবং কোনটি পরে , তা নিয়ে পণ্ডিতরা একমত নন । এই গ্রন্থ দুটি থেকে প্রাচীন যুগের রাজবংশগুলির কীর্তিকলাপ , আর্য - অনার্য সংঘর্ষ , দাক্ষিণাত্যে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার , এই যুগের সামাজিক , রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন , বিভিন্ন সামাজিক প্রথা , বর্ণব্যবস্থা , সমাজে নারী ও শূদ্রের অবস্থান প্রভৃতি নানা বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় । মহাকাব্যে বর্ণিত ঘটনাবলী অতিরঞ্জনদোষে দুষ্ট হলেও সমকালীন যুগের সামাজিক , রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে এদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না ।

প্রাচীন ভারতের পুরাণ 

 ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পুরাণগুলিও যথেষ্ট মূল্যবান । ( আঠারোটি পুরাণের মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ , বায়ুপুরাণ , মৎস্যপুরাণ , ব্রহ্মপুরাণ ও ভবিষ্যপুরাণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য পুরাণগুলিতে কিংবদন্তির যুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজবংশের উৎপত্তি , রাজাদের বংশলতিকা , রাজাদের কার্যকলাপ , প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা , বিভিন্ন নদ - নদী , পাহাড় - পর্বত , প্রাচীন শহর ও তীর্থস্থানগুলির বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে । এ সত্ত্বেও পুরাণগুলি কিন্তু ত্রুটিহীন নয় । এতে বহু কিংবদন্তি ও লোককাহিনি মিশে আছে এবং এদের কালানুক্রমও বিভ্রান্তিকর । 

প্রাচীন ভারতের স্মৃতিশাস্ত্র 

এ প্রসঙ্গে হিন্দু ‘ স্মৃতিশাস্ত্ৰ ’ বা ‘ ধর্মশাস্ত্র ’ - গুলিও মূল্যবান । স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মধ্যে মনু স্মৃতি , নারদ - স্মৃতি , বৃহস্পতি - স্মৃতি , যাজ্ঞবল্ক্য - স্মৃতি , কাত্যায়ন - স্মৃতি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।  এগুলি থেকে প্রাচীন ভারতের সামাজিক রীতি - নীতি , সমাজ - সংগঠন , বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাবলী , রাষ্ট্রীয় কর্তব্য , বিভিন্ন বর্ণের মানুষের নিজ নিজ কর্তব্য এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনসমূহ সম্পর্কে জানা যায় । 

বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ

বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত । পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থ ত্রিপিটক , দীপবংশ , মহাবংশ এবং জাতক খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ত্রিপিটক অর্থাৎ বিনয় পিটক , সূত্ত পিটক ও অভিধর্ম পিটকে বৌদ্ধ ধর্ম ও সঙ্ঘ - সংক্রান্ত তথ্যাবলী পাওয়া যায় । পালি ভাষায় লিখিত সিংহলের ইতিবৃত্ত ‘ দীপবংশ ’ ও ‘ মহাবংশ ’ থেকে বুদ্ধদেব , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক সংক্রান্ত তথ্যাদি মেলে । ‘ জাতক ’ থেকে বুদ্ধদেবের পূর্ববর্তী জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় । গৌতম - রূপে জন্মগ্রহণ করার পূর্বে বুদ্ধদেব ৫৪৭ বার বোধিসত্ত্ব - রূপে জন্মগ্রহণ করেন ।

এক একটি জন্মকাহিনিকে নিয়ে মোট ৫৪৭ - টি জাতক গড়ে উঠেছে । জাতক এবং উল্লিখিত গ্রন্থগুলি থেকে সমকালীন যুগের সমাজ , অর্থনীতি , ধর্ম , বর্ণব্যবস্থা , নগর জীবন , কৃষি ও বাণিজ্য সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায় । বৌদ্ধগ্রন্থ ‘ ললিতবিস্তার ’ , ‘ বৈপুল্য - সূত্র ' এবং অশ্বঘোষ রচিত ‘ বুদ্ধচরিত ’ বুদ্ধদেবের জীবনী - সংক্রান্ত মূল্যবান গ্রন্থ । প্রাকৃত ভাষায় রচিত জৈন ‘ ভগবতী সূত্র ’ , ‘ আচারঙ্গ সূত্র ’ , ভদ্রবাহু রচিত ‘ জৈন কল্পসূত্র ’ , জৈন আচার্য হেমচন্দ্ৰ রচিত ‘ পরিশিষ্টপার্বণ ’ এবং মেরুত্তুঙ্গ সম্পাদিত ‘ প্রবন্ধচিত্তামণি ’ ও রাজশেখর সম্পাদিত ‘ প্রবন্ধকোষ ’ ইতিহাসের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যতত্ত্ব 

 অনেক সময় ব্যাকরণ , অভিধান , জ্যোতির্বিদ্যা এবং আইন - সংক্রান্ত গ্রন্থাদি থেকেও ইতিহাসের মূল্যবান তথ্যাদি পাওয়া যায় । এ সম্পর্কে ‘ গার্গীসংহিতা ' নামক জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ , পাণিনির ব্যাকরণ ‘ অষ্টাধ্যায়ী ’ , ‘ অষ্টাধ্যায়ী ' - র টীকা পতঞ্জলি - র ‘ মহাভাষ্য ' , কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র , কামন্দকের ‘ নীতিসার ’ , বাৎস্যায়নের ‘ কামসূত্র ’ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত । এছাড়া , মহাকবি কালিদাসের বিভিন্ন নাটক যথা — ‘ রঘুবংশম্ ’ , ‘ মালবিকাগ্নিমিত্রম্ ' , ‘ অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ ’ এবং বিশাখদত্তের ‘ দেবীচন্দ্রগুপ্তম্ ’ থেকে গুপ্ত যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস জানা যায় ।

জীবনচরিত  

 প্রাচীন ভারতে রচিত বিভিন্ন জীবনচরিত থেকেও ইতিহাসের তথ্যাদি পাওয়া যায় । বাণভট্ট রচিত ‘ হর্ষচরিত ’ , কাশ্মীরের বিখ্যাত কবি বিহুন - এর বিক্রমাঙ্কদেব চরিত ( কল্যাণের চালুক্য - বংশীয় রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ) , সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘ রামচরিত ’ , জয়সিংহ রচিত ‘ কুমারপাল - চরিত ’ ( চালুক্য - রাজ কুমারপাল ) , পদ্মগুপ্ত রচিত ‘ নবসাহসাঙ্ক - চরিত ’ , বাক্‌পতিরাজ রচিত ‘ গৌড়বাহ ’ , ন্যায়চন্দ্ৰ রচিত ‘ হামিরকাব্য ’ , চাঁদবরদৈ রচিত ‘ পৃথ্বীরাজচরিত ' , বল্লাল রচিত ‘ ভোজপ্রবন্ধ ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান । এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে , এই গ্রন্থগুলি বশংবদ সভাকবিদের দ্বারা রচিত রাজপ্রশস্তি — ইতিহাস নয় এবং স্বভাবতই পক্ষপাতদোষে দুষ্ট । এ সত্ত্বেও এগুলির গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না ।

 আঞ্চলিক ইতিহাস

 কাশ্মীর , গুজরাট , সিন্ধু , নেপাল প্রভৃতি স্থানের কিছু আঞ্চলিক ইতিহাস থেকেও ঐতিহাসিকরা নানাভাবে সাহায্য পান । দ্বাদশ শতকে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ কহুন রচিত ‘ রাজতরঙ্গিনী ’ হল কাশ্মীরের ইতিহাস । এই গ্রন্থে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কাশ্মীরের ধারাবাহিক ও প্রামাণিক ইতিহাস বিবৃত হয়েছে । কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতে এটিই একমাত্র গ্রন্থ যাকে প্রকৃত অর্থে ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করা যায় । কহ্লনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে শ্রীবর , প্রাজ্যভট্ট , শুক প্রমুখ কাশ্মীরের ইতিহাস রচনা করেন । গুজরাটের ইতিহাস জানা যায় সোমেশ্বর রচিত ‘ রাসমালা ’ ও ‘ কীর্তিকৌমুদী ’ , অরিসিংহের সুকৃতি সংকীর্তন ’ , মেরুতুঙ্গের ‘ প্রবন্ধ চিন্তামণি ’ , রাজশেখরের ‘ প্রবন্ধকোষ ’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে । বালাজুরি রচিত ‘ চাচনামা ’ গ্রন্থ থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণ পাওয়া যায় । দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস রচনায় তামিল সঙ্গম সাহিত্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এ সম্পর্কে ‘ নন্দিক কলম্বকাম ’ ও ‘ কলিঙ্গত্তু - পরাণি ’ দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ।


( ২ )প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে  বিদেশি সাহিত্য :  প্রাচীনকালে বহু বিদেশি পর্যটক , ব্যবসায়ী , ধর্মপিপাসু ব্যক্তি এবং বিজেতা ভারতে আসেন । তাঁদের মধ্যে আছেন গ্রিক , রোমান , চৈনিক , তিব্বতীয় ও মুসলিমরা । ভারত সম্পর্কে তাঁরা যে সব বিবরণ রেখে গেছেন , ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সেগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

 প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গ্রিক বিবরণ 

 ( 1 ) বিদেশি লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রথম গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ( Herodotus ) - এর রচনায় ভারতের উল্লেখ পাওয়া যায় । ' ইতিহাসের জনক ' হিসেবে স্বীকৃত হেরোডোটাস কখনও ভারতে আসেন নি । তাঁর রচনা থেকে ভারতের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তে পারসিক বিজয়ের কথা জানা যায় । 

( ২ ) পারস্যের দরবারে দীর্ঘ সতেরো বৎসর অবস্থানকারী গ্রিক চিকিৎসক টেসিয়াস ভারত সম্পর্কেএকটি গ্রন্থ রচনা করেন— ' ইন্ডিকা ' । এই গ্রন্থটি নানা অবিশ্বাস্য কাহিনিতে পূর্ণ । 

( ৩ ) কোনও ভারতীয় সাহিত্যে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় না । এজন্য আমাদের বিদেশি লেখকদের উপরেই নির্ভর করতে হয় । আলেকজাণ্ডারের আক্রমণকালে তিনজন গ্রিক লেখক তাঁর সঙ্গী ছিলেন । তাঁরা হলেন নিয়ারকাস , ওনেসিক্রিটাস এবং এ্যারিটোবুলাস । তাঁদের রচিত বিবরণ খুবই মূল্যবান । এ ছাড়াও ডায়োডোরাস ( Diodorus ) , এ্যারিয়ান ( Arrian ) , জাস্টিন ( Justin ) , প্লুটার্ক ( Plutarch ) এবং রোমান লেখক কুইন্টাস কার্টিয়াস ( Quintus Curtius ) প্রমুখের রচনা থেকে আলেকজাণ্ডারের ভারত অভিযান ও ভারতীয় জীবনের নানা দিকের বিবরণ পাওয়া যায় । 

( ৪ ) গ্রিক লেখকদের মধ্যে মেগাস্থিনিস ( Megasthenes ) বিশেষ উল্লেখযোগ্য । তিনি পশ্চিম এশিয়ার গ্রিক অধিপতি সেলুকাসের দূত হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় বেশ কিছুকাল অবস্থান করেন । তাঁর রচিত ‘ ইন্ডিকা ’ ( ‘ Indika ' ) গ্রন্থে মৌর্য সাম্রাজ্য ও সমকালীন ভারত সম্পর্কে নানা তথ্যাদি আছে । ' ইন্ডিকা’গ্রন্থটি পাওয়া যায় না , কিন্তু এর কিছু কিছু অংশ পরবর্তীকালের স্ট্রাবো ( Strabo ) , এ্যারিয়ান , কার্টিয়াস , ডায়োডোরাস , জাস্টিন প্রমুখের রচনায় উদ্ধৃতি হিসেবে রক্ষিত আছে ।

 ( ৫ ) খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পলিবিয়াস লিখিত ‘ সাধারণ ইতিহাস ( ‘ General History ' ) থেকে বাহ্লিক গ্রিকদের আক্রমণ সম্পর্কে জানা যায় ।

 ( ৬ ) খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে জনৈক অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিক রচিত ‘ পেরিপ্লাস অব দি এরিথ্রিয়ান সী ( ' Periplus of the Erythrean Sea ' ) বা ‘ ভারত মহাসাগর ভ্রমণ ’ , খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত গ্রিক লেখক টলেমি ( Ptolemy ) - র ‘ ভূগোল ’ ( ‘ Geography ' ) এবং খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে লিখিত রোমান পণ্ডিত প্লিনি ( Pliny ) রচিত ‘ প্রাকৃতিক ইতিহাস ’ ( ‘ Natural History ' ) ভারত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । এই তিনটি গ্রন্থ থেকে ভারতের বিভিন্ন বন্দর , পোতাশ্রয় , আমদানি - রপ্তানি দ্রব্য , জীবজন্তু , লতা - গুল্ম , খনিজ সম্পদ এবং রোম ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে নানা মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় । 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে  চিনা ও তিব্বতীয় বিবরণ

ভারতে শক , পহ্লব ও কুষাণ ইতিহাসের ক্ষেত্রে চৈনিক বিবরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ' চিন দেশীয় ইতিহাসের জনক ’ সু - মা - কিয়েন রচিত ' ইতিহাস ' , ' ফা - হিয়েন রচিত ‘ ফো - কুও - কি ’ , হিউয়েন সাঙ্ রচিত ‘ সি - ইউ - কি ’ , ইৎ - সিং এর বিবরণী এবং তিব্বতীয় পণ্ডিত লামা তারানাথ রচিত ‘ ভারতে বৌদ্ধধর্মের জন্ম ’ গ্রন্থ থেকে ভারত ইতিহাসের নানা তথ্যাদি জানা যায় ।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে আরবীয় বিবরণ

মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ভারতে মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের কাহিনি সুবিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন । সুলেমান , অল্ মাসুদি , অল্ বিলাদুরি , হাসান নিজামি , ইবন - উল  আথির প্রমুখের রচনায় এর বিস্তৃত বিবরণ মিলবে । মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন অল্ বিরুনি ( Alberuni ) । এই বিশিষ্ট আরবীয় পণ্ডিত গজনির অধিপতি সুলতান মামুদের সঙ্গে ভারতে আসেন । তিনি দীর্ঘকাল ভারতে বসবাস করে ভারতীয় ধর্ম , দর্শন , বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে অনুশীলন করেন । ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘ তহকক্ - ই - হিন্দ ’ বা ‘ কিতাব - উল - হিন্দ ’ গ্রন্থে সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু ভারতের সমাজ ও ধর্মের এক জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে । 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বিদেশি সাহিত্য সীমাবদ্ধতা

 বিদেশি পর্যটকদের রচনাগুলি ভারত ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হলেও এগুলির নানা সীমাবদ্ধতা আছে । ( ১ ) বিদেশি লেখকরা ভারতে বেশি দিন বসবাস করেন নি । এর ফলে তাঁরা দেশীয় ভাষা , রীতি - নীতি ও আচার - আচরণ সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ ছিলেন । ( ২ ) গ্রিকরা বহু ক্ষেত্রেই জনশ্রুতি বা শোনা কথার উপর নির্ভর করে গ্রন্থাদি রচনা করেছেন । এর ফলে সেগুলি যথার্থ ইতিহাস হতে পারে নি । ( ৩ ) গ্রিক লেখকরা রাজনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন । অপরপক্ষে , চিনারা ধর্মীয় বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । ( ৪ ) অনেকেই বিশেষ বিশেষ শাসকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন । এ সত্ত্বেও এইসব বিবরণ ভারত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । 

( খ ) প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব  

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব আলোচনা করো 

 প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব লেখ ( Archaeological Sources ) : প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব সর্বাধিক । প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সাহায্য ব্যতীত ভারত ইতিহাসের অনেক তথ্যই অজানা থেকে যেত । তাই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে ‘ প্রাচীন ভারত ইতিহাসের নোঙর ' ( “ sheet anchor of Ancient Indian history ” ) বলা হয় । ইউরোপীয় পণ্ডিতদের হাতে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রপাত । এইসব পণ্ডিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্যার উইলিয়ম জোন্স , জেমস্ প্রিন্সেপ ( এশিয়াটিক সোসাইটির সচিব ) , হ্যামিল্টন বুকানন , স্যার আলেকজাণ্ডার কানিংহাম , স্যার জন মার্শাল ( কেন্দ্রীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধিকর্তা ) , স্যার অরেল স্টাইন এবং জেমস বারজেস্ । যে সব ভারতীয় গবেষক এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , দয়ারাম সাহানি , কাশীনাথ দীক্ষিত , ননীগোপাল মজুমদার এবং ভগবান লাল ইন্দ্রজি । এইসব ইউরোপীয় ও ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিরলস গবেষণার ফলে ভারত ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় ইতিহাসের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে । প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায় – ( ১ ) লিপি , ( ২ ) মুদ্রা এবং ( ৩ ) প্রাচীন স্মৃতিসৌধ ও স্থাপত্য - ভাস্কর্য । 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নির্ণয় লিপি ও মুদ্রার গুরুত্ব আলোচনা করো 

 ( ১ ) লিপি : প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে লিপির গুরুত্বই সর্বাধিক । লোহা , সোনা , তামা , ব্রোঞ্জ , মাটির তৈরি নানা দ্রব্যাদি , ইট , পাথর , ঘর - বাড়ি , মন্দির - গাত্র— এমনকী দেবমূর্তির উপর নানা লেখা থেকে ইতিহাসের প্রচুর উপাদান সংগৃহীত হয়েছে ।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় লিপির গুরুত্ব 

ইতিহাসের উপাদান হিসেবে নানা কারণে লিপির গুরুত্ব অপরিসীম । 

( ১ ) যুদ্ধ - বিগ্রহ , জন্ম - মৃত্যু বা বিশেষ কোনও ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখা , মন্দির নির্মাণ , ভূমিদান , ধর্মপ্রচার বা রাজকীয় নির্দেশ প্রচার প্রভৃতি বহু উদ্দেশ্যে লিপি উৎকীর্ণ করা হত । এইসব লিপিগুলি ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ । এগুলি থেকে রাজার নাম , রাজত্বকাল , সন - তারিখ , বিশেষ রাজার রাজ্যের আয়তন , রাজ্যজয় , ধর্মবিশ্বাস , অন্যান্য কার্যকলাপ এবং সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ের কথা জানা যায় । 

( ২ ) পাথর এবং বিভিন্ন ধাতুর উপর লিখিত হওয়ায় লিপিগুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ , পোকা - মাকড় ও মহাকালের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে । 

( ৩ ) পুরাণ এবং বিভিন্ন সাহিত্য - গ্রন্থগুলি যুগ যুগ ধরে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে । লিপিগুলিকে কিন্তু কোনও অবস্থাতেই পরিবর্তন করা যায় না । এই কারণে লিপিগুলির সত্যতা প্রশ্নাতীত । 

( ৪ ) বহু লিপিতেই সন - তারিখের কোনও উল্লেখ নেই , কিন্তু এ সত্ত্বেও এইসব লিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা থেকে লিপির কাল - নির্ণয় করা যায় । 

( ৫ ) লিপিগুলির প্রাপ্তিস্থান থেকে বিশেষ কোনও যুগে ওই অঞ্চলের উপর বিশেষ রাজার আধিপত্য বা তাঁর রাজ্যের আয়তন সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায় । 

( ৬ ) লিপিতে উল্লিখিত বিষয়সমূহ ও রাজার আদেশ দেশের সামাজিক , রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের নানা দিকের উপর আলোকপাত করে ।

( ৭ ) লিপির খোদাই ও আধার থেকে সমকালীন পাথর ও ধাতুশিল্পের অগ্রগতি - অবনতির কথা জানা যায় । 

( ৮ ) বিদেশি লিপিগুলি থেকে বহির্ভারতের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক , বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কথা জানা যায় । তাই সবদিক বিচার করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে , প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে লিপি সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী ।

বর্ণমালা ও ভাষা

 ভারতে প্রাপ্ত লিপিগুলির মধ্যে হরপ্পার লিপিই প্রাচীনতম — তবে এই লিপিগুলি আজও সর্বাংশে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি । বর্তমানে পণ্ডিতরা সোহগোর তাম্রলিপিকেই ( Sohgaura Copper Plate ) ভারতের প্রাচীনতম লিপি বলে মনে  করেন । এই তাম্রলিপি সম্রাট অশোকের পঞ্চাশ বছর পূর্বে রচিত হয় । হরপ্পাবাসী চিত্রলিপির সাহায্যে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত । ভারতে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের লিপিগুলিতে প্রাকৃত ভাষা ব্যবহৃত হত । খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে লিপিগুলিতে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার শুরু হয় এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে এর প্রচলন বৃদ্ধি পায় । এ সত্ত্বেও লিপির মাধ্যম হিসেবে প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার চলতে থাকে । গুপ্ত যুগের পূর্ববর্তীকালের লিপিগুলির শতকরা ৯৫ ভাগই প্রাকৃত ভাষায় লিখিত । গুপ্তযুগ থেকে লিপির মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃতের বহুল প্রচলন দেখা দেয় । ভারতের অভ্যন্তরে সম্রাট অশোকের লিপিগুলিতে প্রাকৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপিবা হরফ ব্যবহৃত হয়েছে এবং এগুলি বামদিক থেকে ডানদিকে লেখা হত । স্থানীয় জনগণের সুবিধার জন্য কেবলমাত্র সাম্রাজ্যের উত্তর - পশ্চিমাঞ্চলে অশোকের লিপিগুলিতে খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহৃত হত এবং এগুলি ডান দিক থেকে বামদিকে লিখিত হত । আফগানিস্তানে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপিগুলিতে গ্রিক ও অ্যারামিক লিপির ব্যবহার দেখা যায় । খ্রিস্টীয় নবম ও দশম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লিপির ব্যবহার শুরু হয় ।

 বিভিন্ন লিপি

 লিপিগুলির বিষয়বস্তু বিবেচনা করে পণ্ডিতরা প্রাচীন ভারতীয় লিপিগুলিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছেন — ধর্মলিপি , শাসনতান্ত্রিক লিপি , প্রশস্তিবাচক লিপি , উৎসর্গীকৃত লিপি , দানসূচক লিপি , স্মরণসূচক লিপি , পারিবারিক লিপি ও ব্যক্তিগত লিপি । সম্রাট অশোকের লিপিগুলি থেকে তাঁর ধর্মমত ও বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাদি সম্পর্কে জানা যায় । শকরাজা রুদ্রদামনের ‘ জুনাগড় প্রস্তর লিপি’এবং হর্ষবর্ধনের ‘ বান্সখেরা তাম্রশাসন ’ শাসনতান্ত্রিক লিপির উদাহরণ । সমুদ্রগুপ্তের ‘ এলাহাবাদ প্রশস্তি ’ , কলিঙ্গ - রাজ খারবেলের ‘ হস্তিগুম্ফা শিলালিপি ’ , চালুক্য - রাজ দ্বিতীয় পুলকেশির ‘ আইহোল প্রশস্তি ’ , গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর ‘ নাসিক প্রশস্তি ’ , প্রতিহার - বংশীয় রাজা ভোজের ‘ গোয়ালিয়র প্রশস্তি ’ থেকে ইতিহাসের নানা তথ্যাদি জানা যায় । ভারতের বাইরে এশিয়া মাইনরের বোঘাজ - কোই নামক স্থানে প্রাপ্ত ‘ বোঘাজ - কোই শিলালিপি ' আর্যদের ভারতে আগমন সম্পর্কে আলোকপাত করে । পারস্যের বেহিস্তান ,  পার্সেপলিস ও নাকশ্ - ই - রুস্তম নামক স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে ভারত - পারস্য যোগাযোগ ও ভারতের উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে পারসিক আধিপত্যের কথা জানা যায় ।

বহির্ভারতীয় শিলালিপি

 চম্পা , কম্বোজ এবং বৃহত্তর ভারতের নানা স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে বহির্ভারতে ভারতীয় বাণিজ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নানা তথ্যাদি পাওয়া যায় ।  সামগ্রিকভাবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে , প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে লিপি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী এবং সামাজিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস রচনায় তা সাহিত্য থেকে প্রাপ্ত উপাদানগুলির পরিপূরক । লিপি ব্যতীত বহু ঘটনা , রাজা ও রাজবংশের নাম চিরদিন অজ্ঞাতই থেকে যেত ।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মুদ্রার গুরুত্ব

( ২ ) মুদ্রা : প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লিপির পরেই মুদ্রা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী ।

 ( ১ ) সাহিত্য ও শিলালিপি থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায় , গুরুত্ব সেগুলির সত্যতা যাচাই করতে মুদ্রা যথেষ্ট সাহায্য করে ।

 ( ২ ) মুদ্রাগুলিতে সাধারণত রাজার নাম , সন - তারিখ , রাজার মূর্তি ও নানা দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা থাকে । ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ ।

 ( ৩ ) কেবলমাত্র রাজার নাম , রাজত্বকাল , ধর্মমত বা তাঁর শখ নয়— এইসব মুদ্রাগুলি থেকে একটি রাজ্যের ধাতুশিল্প , শিল্পকলা , রাজ্যে ব্যবহৃত লিপি এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় । 

( ৪ ) ভারতে প্রচুর পরিমাণ রোমান মুদ্রার অস্তিত্ব রোমের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক , ভারতের অনুকূল বাণিজ্য , ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং ভারতবাসীর সমুদ্রযাত্রার সাক্ষ্য বহন করে । (

 ৫ ) মুদ্রার উপর অঙ্কিত রাজাদের মূর্তি থেকে তাঁদের মস্তক - সজ্জার পরিচয় পাওয়া যায় ।

 ( ৬ ) কুষাণ রাজ কণিষ্কের মুদ্রায় অঙ্কিত বিভিন্ন ধর্মের দেবদেবীর মূর্তি থেকে তাঁর সমন্বয়ী ধর্মাদর্শ ও পরধর্মমত - সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায় । 

( ৭ ) গুপ্ত - রাজ সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রাগুলি থেকে তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞ , শিকারপ্রিয়তা ও সংগীতানুরাগের কথা জানা যায় । 

( ৮ ) প্রাচীন ভারতে স্বর্ণ , রৌপ্য , তাম্র ও সিসার মুদ্রা প্রচলিত ছিল । স্বর্ণমুদ্রার অধিকতর প্রচলন নিঃসন্দেহে রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচায়ক । অপরপক্ষে , কেবলমাত্র তাম্র বা সিসার মুদ্রার আধিক্য বা মুদ্রায় স্বর্ণের পরিমাণ হ্রাস করা রাজ্যের আর্থিক সংকটের পরিচায়ক । 

মুদ্রার ধরন 

ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম মুদ্রাগুলিতে কেবলমাত্র মূর্তি ও প্রতীক - চিহ্নাদি দেখা যায় । অনেক সময় একই মুদ্রার উপর বিভিন্ন যুগ বা বিভিন্ন রাজার একাধিক প্রতীক - চিহ্নের অস্তিত্ব দেখা যায় । সম্ভবত মুদ্রার যথার্থতা রক্ষার জন্যই কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় পূর্ববর্তী যুগের মুদ্রার উপর তাঁদের নিজেদের প্রতীক অঙ্কিত করতেন । প্রাচীন ভারতে মুদ্রার উপর রাজার একচেটিয়া কর্তৃত্বের ধারণা জন্মায় নি , কারণ এ সময় কেবলমাত্র রাজাই নন – ব্যক্তিগতভাবে অনেক ব্যবসায়ী , বাণিজ্য সংস্থা ও নগর শাসন - সংস্থা মুদ্রা প্রবর্তন করতেন ।

 গ্রিক শাসনের ইতিহাস 

ভারতে গ্রিক আক্রমণের পর মুদ্রার উপর রাজার নাম লেখার পদ্ধতি প্রচলিত হয় । পাঞ্জাব ও উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ব্যাকট্রিয়ার গ্রিক রাজাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় । তাঁদের মুদ্রার শিল্প - নৈপুণ্য , মুদ্রার উপর রাজার নাম খোদাই , রাজা বা অন্য কোনও মূর্তি অঙ্কন - রীতি ভারতীয় মুদ্রাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে এবং ভারতীয় মুদ্রাতেও রাজার নাম , সময় ও মূর্তি অঙ্কনের পদ্ধতি শুরু হয় । বলা বাহুল্য , এই গ্রিক মুদ্রাগুলি থেকে এই অঞ্চলের পূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায় । গ্রিক লেখকদের রচনায় এই অঞ্চলে রাজত্বকারী মাত্র চার - পাঁচজন রাজার উল্লেখ আছে । অপরদিকে মুদ্রাগুলি থেকে ত্রিশজন রাজা ও রানির নাম পাওয়া গেছে । মুদ্রার সাহায্য ব্যতীত এই অঞ্চলে গ্রিক আধিপত্যের ইতিহাস অজ্ঞাতই থেকে যেত । 

শক , পার্থিয়ান, কুষাণ ইতিহাস 

অনুরূপভাবে শক , পার্থিয়ান ও কুষাণদের ইতিহাস রচনায় মুদ্রাই একমাত্র অবলম্বন । মুদ্রার সাহায্যেই তাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের একটি রূপরেখা   মাত্র অঙ্কন করা সম্ভব হয়েছে । কুষাণ ইতিহাস রচনায় মুদ্রা ‘ মেরুদণ্ড ' কুষাণ ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃত । কয়েকটি লিপি ও সামান্য কিছু সাহিত্য - গ্রন্থ বাদ দিলে মুদ্রা ব্যতীত এইসব বিদেশি রাজবংশের ইতিহাস রচনা একেবারেই সম্ভব হত না ।

কয়েকটি দেশীয় রাজ্য 

 মল্ল , যৌধেয় ও পাঞ্চালের মিত্র প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাস কেবলমাত্র মুদ্রা থেকেই জানা যায় । দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন বংশের ইতিহাস রচনায় মুদ্রা ও শিলালিপি পুরাণ থেকে প্রাপ্ত বিবরণগুলির সমর্থক , সংশোধক ও পরিপূরকের কাজ করে । গুপ্ত আমলের প্রচুর মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে । সেগুলিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ । গুপ্ত বংশের পরবর্তীকালের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব ততটা নয় , কারণ এ সময় থেকে ইতিহাসের অন্যান্য উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া গেছে । হর্ষবর্ধন বা পাল - চোল - চালুক্য - প্রতিহার - রাষ্ট্রকূট প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব অকিঞ্চিৎকর । এ সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না ।  

( ৩ ) প্রাচীন স্মৃতিসৌধ ও স্থাপত্য - ভাস্কর্য  

 সূচনা 

 প্রাচীন নগর , মঠ , মন্দির , দুর্গ , অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ , সমাধি , স্তম্ভ , স্মৃতিস্তম্ভ , প্রাচীন শিল্পকীর্তি , মৃৎশিল্প , মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্রাদি প্রাচীন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত । রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও শিল্পকলার বিবর্তনে এইসব উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম । এগুলি থেকে বিশেষ যুগের শিল্পকলা , ধর্ম ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায় ।

বিভিন্ন সভ্যতা

সিন্ধু উপত্যকার খননকার্য ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ধারণাকেই পরিবর্তিত করে দিয়েছে । এর ফলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব নির্ধারিত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে এবং প্রমাণিত হয়েছে যে , আর্য সভ্যতার পূর্বে ভারতে এক উন্নত নগর সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল । সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর ভারতের বিভিন্ন স্থানে খননকার্য চালিয়ে নতুন নতুন সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে । বিহারের সারনাথ , পাটলিপুত্র , নালন্দা এবং উত্তর - পশ্চিম সীমান্তের তক্ষশিলায় খননকার্যের ফলে বৌদ্ধ ও আর্য সংস্কৃতির নানা নতুন দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে । তক্ষশিলা থেকে গ্রিক , পহ্লব , শক ও কুষাণ যুগের সভ্যতার নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । হস্তিনাপুর ও কৌশাম্বী থেকে পৌরাণিক যুগের নানা নিদর্শন পাওয়া যায় । মৌর্য যুগের বরাবর গুহা , গুপ্তযুগে অজন্তা - ইলোরার গুহা চিত্রাবলী , ভিতারগাঁও ও দেওগড়ের মন্দির এবং দক্ষিণের চোল - চালুক্য - পল্লব রাজাদের স্থাপত্য - ভাস্কর্য ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ । বেলুচিস্তান ও তুর্কিস্তানে খননকার্যের ফলে ওইসব অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা জানা যায় ।



 





Post a Comment

0 Comments