ক্ষমতা সংজ্ঞা দাও , ক্ষমতা কাকে বলে ক্ষমতার মূল উপাদানগুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো, ক্ষমতার শ্রেণি বিভাজন

ক্ষমতা বা শক্তি [ Power ]

ক্ষমতা কাকে বলে ক্ষমতার মূল উপাদানগুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো ।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । হ্যান্স মরগেনথাউ ( Hans Morgenthau ) - এর মতে , ক্ষমতা হল অন্যের মন ও কাজকর্মের ওপর একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণ । তিনি ' রাজনৈতিক ক্ষমতা ’ ( political power ) বলতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারীদের নিজেদের মধ্যে এবং সাধারণভাবে তাদের সঙ্গে জনগণের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ মূলক সম্পর্ক ( mutual relations of control ) - কে বোঝাতে চেয়েছেন । অনুরূপভাবে , জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল ( Joseph Frankel ) বলেছেন যে , অন্যের মন ও কার্যকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা । আবার , কার্ল ডয়েস্ ( Karl Deutsch ) - এর মতে , আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে শক্তি হল ‘ একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্যান্য রাষ্ট্রের আচরণকে তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য । ' সুতরাং বলা যায় , ক্ষমতা বলতে অন্যকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যকে বোঝায় , যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকারী তার ইচ্ছামতো কাজ করতে অন্যদের বাধ্য করে । 

প্রকৃতি ( Nature )

 সরকার তথা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা অনেকাংশে শক্তি বা ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল । তবে কেবলমাত্র ক্ষমতাপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শনই যথেষ্ট নয় , ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য অনেক সময় রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক পুরস্কার প্রদান , সহযোগিতা ও মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সংহতিসাধন প্রভৃতির মাধ্যমে অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হয় ।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা কে 👇👇👇

👉 👉👉মন্তেস্কু

👉👉মন্টেস্কু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত  “The spirit of laws” গ্রন্থে।

উদ্দেশ্যসাধনের উপায় [ Means of Fulfillment of the Purpose ]

 অনেক সময় ক্ষমতাকে উদ্দেশ্যসাধনের উপায় বলে মনে করা হয় । কৌলম্বিস ও উলফে ( Couloumbis and Wolfe ) মনে করেন যে , শান্তি , নিরাপত্তা , জাতীয় উন্নয়ন প্রভৃতি লক্ষ্যপূরণের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে । অনেক সময় আবার নিজের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায় । কিন্তু মরগেনথাউ প্রমুখ বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা ক্ষমতাকে একই সঙ্গে লক্ষ্য ( end ) এবং লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায় ( means to an end ) বলে মনে করেন । তাঁদের মতে , শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি তাদের লক্ষ্যপূরণের জন্য ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ করে থাকে । এক্ষেত্রে ক্ষমতা হল লক্ষ্যপূরণের একটি উপায়মাত্র । কিন্তু শক্তিধর হতে না পারলে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । তাই ক্ষমতা অর্জন করাই হল প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য । এরূপ ক্ষেত্রে ক্ষমতা নিজেই নিজের লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয় । আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতার ধারণা গড়ে উঠেছে । এই দুটি অনুমান হল— [ ১ ] ক্ষমতা বলতে যুদ্ধ করার সামর্থ্যকে বোঝায় এবং [ ২ ] ক্ষমতা পরিমাপযোগ্য । কিন্তু এই দুটি অনুমানের বাস্তব ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল । কারণ , বর্তমান পারমাণবিক যুগে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি আক্রমণের ভয় দেখিয়ে পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও তারা নিজেরা একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । কারণ , ভীতি প্রদর্শনকারী রাষ্ট্রের কাছে যেমন পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে , তেমনি যাকে ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে , সে - ও একই ধরনের অস্ত্রের অধিকারী । সুতরাং বলা যায় , বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে অসামরিক উপাদানের গুরুত্ব আদৌ উপেক্ষণীয় নয় । আবার , অর্গানস্কি ( Organski ) -র মতো অনেকেই মনে করেন যে , আন্তর্জাতিক ক্ষমতার পরিমাণ পরিমাপ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয় । কারণ , এর সঙ্গে বহু বোধগম্যহীন ( intangible ) উপাদান জড়িত থাকে ।

ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য [ Differences between Power and Force ]

 অনেক সময় ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগকে অভিন্ন বলে মনে করা হয় । কিন্তু কৌলম্বিস ও উল্ফে ভিন্নমত পোষণ করেন । বলপ্রয়োগ বলতে তাঁরা সামরিক শক্তির প্রয়োগকে বোঝাতে চেয়েছেন । কিন্তু ক্ষমতার ধারণা অনেক বেশি ব্যাপক । ক্ষমতা বলতে কেবল বলপ্রয়োগ কিংবা বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শনকেই বোঝায় না , সেই সঙ্গে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের অনুকূলে আনয়ন , অর্থনৈতিক পুরস্কার প্রদান , সহযোগিতামূলক কার্য ও মতাদর্শগত ঐক্যের মতো ইতিবাচক এবং অহিংস পদ্ধতির অনুসরণকেও বোঝায় ।  ক্ষমতা ও প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য [ Differences between Power and Influence ] কেউ কেউ ক্ষমতা এবং প্রভাব ( influence ) - কে সমার্থক বলে মনে করলেও স্লেইচার ( Schleicher ) উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন । নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাউকে পুরস্কার বা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি প্রদান কিংবা তাদের কাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু থেকে বঞ্চিত করার ভয় দেখিয়ে অথবা বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন ক'রে কোনো কাজ করতে বাধ্য করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বলা হয় । কিন্তু প্রভাব বলতে বলপ্রয়োগ না ক'রে বুঝিয়ে - সুঝিয়ে অন্যকে কোনো একটি কাজ করার বা কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে তার সম্মতি আদায় করাকে বোঝায় । তাই কৌলম্বিস ও উল্ফে ক্ষমতাকে বলপ্রয়োগ এবং প্রভাবের মধ্যবর্তী ও সমন্বয়সাধনকারী ধারণা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।

শ্রেণি বিভাজন ( Classification )

 আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাকে ই . এইচ . কার ( E. H. Carr ) নিম্নলিখিত তিন ভাগে ভাগ করেছেন :

 সামরিক ক্ষমতা :  একটি রাষ্ট্র কতখানি শক্তিশালী , তা তার সামরিক ক্ষমতা ( Military Power ) - র ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভর করে । এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে স্পাইকম্যান ( Spykman ) বলেছেন যে , সর্বশেষ বিচারে যুদ্ধ করার সামর্থ্যের মধ্যে একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় । বস্তুত , অতীতের মতো বর্তমানেও সেইসব রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ ও বৃহৎ শক্তির মর্যাদা দেওয়া হয় , যারা সামরিক শক্তিতে যথেষ্ট বলীয়ান । আবার , অনেক সময় নিজের সামরিক ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে কোনো কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত হয় । যুদ্ধে জয়পরাজয় যুদ্ধরত দেশগুলির আন্তর্জাতিক মানমর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটায় । অর্থনৈতিক ক্ষমতা : সামরিক ক্ষমতার মতো

 অর্থনৈতিক ক্ষমতা ( Economic Power ) - র অধিকারী রাষ্ট্রগুলি বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করতে সক্ষম । কারণ , যথেষ্ট সম্পদশালী রাষ্ট্র সহজেই যুদ্ধ করার ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারে । তাই তারা যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে অতি সহজেই অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় । এইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বরাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে । 

জনমত গঠনের ক্ষমতা : বিশ্বরাজনীতিতে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ( Power over opinion ) - র মতো জনমত গঠনের ক্ষমতাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় । প্রতিটি সরকার তার দেশের জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও তাদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যেমন প্রচারকার্য চালায় , তেমনি বিদেশি জনগণের সমর্থন লাভের জন্যও তা করে থাকে । বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষমতা যে - রাষ্ট্রের যত বেশি থাকে , সেই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে তত বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় । সুতরাং বলা যায় , ক্ষমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রসমূহের মর্যাদা নির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত হয় । 


ক্ষমতা কাকে বলে ক্ষমতার উপাদানগুলি আলোচনা করো

 আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পাঠ ( The study of International Relations ) - এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতা ( national power ) - র বিচারবিশ্লেষণ । তাই কেবল ‘ শক্তি বা ক্ষমতা ' শব্দটি ব্যবহার করার পরিবর্তে ' জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতা ’ কথাটি প্রয়োগ করা সমীচীন বলে মনে করা হয় । কারণ , এরূপ করার সময় ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে জাতীয় নেতৃবৃন্দ কিংবা তাঁদের বক্তব্যের পরিবর্তে বিশ্লেষণের একক ( unit ) হিসেবে জাতি ( nation ) সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায় । এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ডেভিস্ ( Davis ) বলেছেন যে , একটি অরণ্যে বৃহৎ বৃক্ষগুলি যেমন তাঁর ‘ সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে পরিবেশগত সাম্য ' ( ' The ecological balance of all the organisms ' ) - কে নিয়ন্ত্রণ করে , তেমনি শক্তিধর জাতিসমূহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের ধরন ও গতিপ্রকৃতি ' ( ' the pattern and the trend of relations ' ) নির্ধারণ করে দেয় । তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের শক্তির পরিবর্তে জাতীয় শক্তির সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে । 

ক্ষমতার উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করো

          জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহের শ্রেণিবিভাজন নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশারদদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা গেলেও কার্যক্ষেত্রে তাঁরা প্রায় অভিন্ন উপাদানগুলিকেই চিহ্নিত করেছেন । তাঁদের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য লক্ষ করা যায় , তা কেবল শব্দচয়ন ও শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে পার্থক্য মাত্র । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , কার ( E. H. Carr ) জাতীয় ক্ষমতাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন , যথা 

[ ১ ] সামরিক ক্ষমতা ( military power ) , [ ২ ] অর্থনৈতিক ক্ষমতা ( economic power ) এবং [ ৩ ] জনমত গঠনের ক্ষমতা ( power over opinion ) । আবার , মরগেনথাউ এরূপ শক্তির উপাদানগুলিকে দুটি পৃথক ভাগে ভাগ করে সেগুলির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের কাজে সচেষ্ট হয়েছেন । 

এই দুটি ভাগ হল— [ ১ ] ‘ অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ' উপাদান ( ' relatively stable ' elements ) , যেমন — ভূগোল , প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি এবং [ ২ ] ‘ অবিরাম পরিবর্তনশীল ’ উপাদান ( elements ‘ subject to constant change ' ) , যথা — শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাসের নৈতিক ক্ষমতা , কূটনীতি প্রভৃতি । 

কৌলম্‌বিস ও উল্ফে জাতীয় ক্ষমতার উপাদানগুলিকে [ ১ ] ‘ বোধগম্য ' ( ' tangible ' ) এবং [ ২ ] ‘ বোধগম্যহীন ' ( ' intangible ' ) — এই দুভাগে ভাগ করেছেন । ‘ বোধগম্য ’ উপাদানগুলি হল ভূখণ্ড , জনসংখ্যা , প্রাকৃতিক সম্পদ , সামরিক ক্ষমতা ইত্যাদি এবং নেতৃত্ব , সরকারের প্রকৃতি , জাতীয় চরিত্র , আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি প্রভৃতি ‘ বোধগম্যহীন ’ উপাদানের অন্তর্ভুক্ত ।

ক্ষমতার উপাদানগুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা

 কিন্তু হার্টম্যান ( Hartmann ) , পামার ও পারকিস ( Palmer and Perkins ) এবং ফ্র্যাঙ্কেল ( Frankel ) জাতীয় শক্তির উপাদানগুলিকে সাধারণভাবে যথাক্রমে ছ - ভাগে , সাত ভাগে ও পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন । এইসব উপাদানের মধ্যে ভূগোল , জনসংখ্যা , প্রাকৃতিক সম্পদ , শিল্পের উন্নতি , সরকার ও কূটনীতি , সামরিক প্রস্তুতি , জাতীয় চরিত্র ও মনোবল , আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি প্রভৃতি হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।

উপসংহার 

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে , কোনো একটি দেশের জাতীয় শক্তি কতখানি , তা বিচার করার সময় কেউ কেউ বিশেষ কোনো একটি উপাদানকে এরূপ শক্তির নির্ধারকের আসনে বসিয়ে অন্যান্য উপাদানের গুরুত্বকে কার্যত অস্বীকার করেন । উদাহরণ হিসেবে ভূ - রাজনৈতিক তত্ত্ব ( Geo - political Theory ) কিংবা সমরবাদ , ( Militarism ) - এর প্রবক্তারা যথাক্রমে কেবল ভূগোল ও সামরিক শক্তিকে জাতীয় শক্তির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন । কিন্তু এরুপ করা আদৌ যুক্তিসংগত নয় । কারণ , জাতীয় শক্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক উপাদান , জনসংখ্যা , প্রাকৃতিক সম্পদ , শিল্পোন্নতি , সামরিক প্রস্তুতি প্রভৃতির মতো পার্থিব উপাদানগুলির মতোই জাতীয় চরিত্র , জাতীয় আত্মবিশ্বাসের নৈতিক শক্তি , আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি , জাতীয় নেতৃত্ব প্রভৃতির মতো অপার্থিব উপাদানগুলিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে । প্রতিটি উপাদান নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করলেই কেবল একটি দেশ বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয় । কোনো একটি উপাদান প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি থাকলেই যে সেই দেশটি বৃহৎ বা অতি বৃহৎ জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে , এমন কোনো কথা নেই । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , জনসংখ্যার দিক থেকে চীন ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় । কিন্তু এই দুটি রাষ্ট্রের কোনোটিই জাতীয় শক্তি হিসেবে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে নেই । এই বিপুল সংখ্যক জনগণের খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান , শিক্ষা , স্বাস্থ্য প্রভৃতি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা দুটি দেশের সরকারের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে । আবার , ক্ষুদ্র জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাষ্ট্র হয়েও ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল । এ ছাড়াও অন্য একটি বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন । তা হল — যখনই কোনো দেশের জাতীয় শক্তির বিচার করা হবে , তখন সবসময়ই অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশটির তুলনামূলক বিচারবিশ্লেষণ করা প্রয়োজন । অন্যথায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে পারে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় শক্তিকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে জার্মানির শক্তিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল । তাই ওই দুটি দেশের সরকার হিটলারকে তোষণ করার নীতি গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করেনি । কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল স্তালিনের নেতৃত্বাধীন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন । আবার , জাতীয় শক্তি সম্পর্কে আলোচনার সময় অন্য একটি বিষয়ও স্মরণ রাখা প্রয়োজন । তা হল — জাতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো একটি দেশের ক্ষেত্রে যেসব উপাদান একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে , অন্য সময়ে সেইসব উপাদানের ওই ভূমিকা নাও থাকতে পারে । এক সময় ইংলিশ প্রণালী ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করলেও আজকের দিনে জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকেজো ক'রে দেওয়া সম্ভব । সর্বোপরি , জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদানের অবস্থিতিই যথেষ্ট নয় । একটি দেশের সরকার সেগুলির যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে কি না , তার ওপর ওই দেশের জাতীয় শক্তি নির্ভর করে । 


আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব ( Importance of Power in International Politics )

 রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতা বা শক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত । তাই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মতো আন্তর্জাতিক রাজনীতিও ক্ষমতা বা শক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় । তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা সবসময় দৃশ্যমান নয় । কারণ , বিভিন্ন প্রকার সামাজিক ও আইনগত শক্তি ( forces ) - র দ্বারা তা সীমাবদ্ধ । কেবল শেষ অস্ত্র হিসেবেই রাষ্ট্র তার ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ করে । কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ওপর কম বাধানিষেধ আরোপিত হয় বলে তা বিশেষভাবে দৃশ্যমান থাকে । তা ছাড়া , আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলিকেই ‘ শক্তি ’ বলে অভিহিত করা হয় । ক্ষমতার মানদণ্ডে তাদের অতিবৃহৎ শক্তি , বৃহৎ শক্তি , মাঝারি শক্তি , ক্ষুদ্র শক্তি এবং অতিক্ষুদ্র শক্তি — এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয় । আন্তর্জাতিক জনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই কমবেশি সচেষ্ট থাকে । তাই নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হয় । একটি রাষ্ট্র অত্যাধিক পরিমাণে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে অন্য রাষ্ট্র জোট গঠন , হস্তক্ষেপ ও হস্তক্ষেপ থেকে বিরতি , যুদ্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করে । এইভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিসাম্য ( balance of power ) প্রতিষ্ঠিত হয় । ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার জন্য রাষ্ট্রসমূহ যেসব কার্য সম্পাদন করে , আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেগুলিকে ক্ষমতার রাজনীতি ( power politics ) বলা হয় । বাস্তববাদী তত্ত্ব ( Realist Theory ) - এর প্রবক্তারা ক্ষমতা বা শক্তিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করেন । তাই তাঁদের চোখে আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল শক্তি বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ( Struggle for power ) । বস্তুত , বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হিসেবে কতকগুলি আদর্শকে তুলে ধরলেও বাস্তবে শক্তি বা ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যেই তাঁদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় । কারণ , তাঁরা এ কথা ভালোভাবেই জানেন যে , শক্তিহীন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না ।


Post a Comment

0 Comments