সম্প্রদায় কাকে বলে সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

সম্প্রদায় কাকে বলে সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । তাই সমাজ তাই পারস্পারিক সম্পর্ক গঠন এবং জীবনে একাকী বসবাসের কোন প্রশ্ন নেই । বলা বাহুল্য তা সম্ভবও নয় । সম্পর্ক সংগঠনের প্রতি সচেতনতার অর্থই হল সমাজবদ্ধতা । এখানে প্রত্যেকেই এক এক সমাজগোষ্ঠীর সদস্য । কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কের প্রগাঢ়তায় এই গোষ্ঠীবদ্ধতার গন্ডী উন্মুক্ত হয়ে সকলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় । তবুও বলা যায় , মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের প্রভাব তো স্বতন্ত্রভাবেই থেকেই যায় । সমাজের বৈচিত্র্যের শুরু সেখান থেকেই । এই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে আবার একটি স্বতন্ত্র অঞ্চলের প্রভাব দেখা যায় । দীর্ঘকাল একই অঞ্চলে একই গোষ্ঠীতে বসবাসের ফলে গোটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক বৃহত্তর অভিন্নতা গড়ে ওঠে আর তার থেকেই দেখা দেয় একটি জনসম্প্রদায় বা community 

এখন প্রশ্ন সম্প্রদায় কি ? সম্প্রদায় কাকে বলে 

 সাধারণত একই জীবনধারায় ক্ষুদ্র / বৃহৎ গোষ্ঠীর সদস্যদের একত্রিত বসবাস করলে সেই সকল গোষ্ঠীকে সম্প্রদায় বলে । অধ্যাপক ম্যাকাইভার এবং পেজের ( R.M. Maclver and C.H. Page ) ভাষায় গোষ্ঠী ছোট অথবা বড় যাই হোক না কেন , সদস্যরা একত্রে বসবাসের মধ্যে দিয়ে একে অপরের অংশীদার হয় , অথচ কোন বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থের প্রয়োজনে তারা অবস্থান করেন না । এই প্রকার গোষ্ঠীগুলি সম্প্রদায় হিসাবে চিহ্নিত হয় । তারা মনে করেন সম্প্রদায়গত জীবনধারার সভ্যন্তরে মানবজীবনের যাবতীয় মানবীয় সম্পর্কের সূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব । ম্যাকাইভার ও পেজ সম্প্রদায়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে আরও বলেছেন যে সম্প্রদায় হল একটি স্থায়ী সামাজিক গোষ্ঠী যা তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত । তারা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের ওপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন । 

যথা :     ১ ) একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং     ২ ) সমষ্টিগত মানসিকতা ।

 সমাজ ভূগোলের রূপরেখা অধ্যাপক জিসবার্ট ( P. Gisbert ) - এর মতে মানুষ তার সার্বিক প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করে একটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করে এবং তাতেই তারা গোটা জীবন অতিবাহিত করে । এই প্রেক্ষাপটে এটি একটি স্বেচ্ছামূলক গোষ্ঠী । অধ্যাপক অগবার্ন এবং অধ্যাপক নিমকফ্ ( W.F. Ogburn and M.F. Nimkoff ) মনে করেন সম্প্রদায় ধারণার একটা ভিত্তি হল নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের সাথে নিবিড় সংযোগ স্থাপন এবং সমষ্টিগত মনোভাবের উৎপাদন । অধ্যাপক কিংসলে ডেভিসের ( K. Davis ) ভাষায় , সম্প্রদায় হল একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ আঞ্চলিক গোষ্ঠী এবং এর সদস্যদের সকল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয় ।

 সুতরাং সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা থেকে এরূপ ধারণা করা যায় যে সম্প্রদায় হল এমন অঞ্চলভিত্তিক মানবগোষ্ঠী , যা ধারাবাহিক এবং স্থায়ীকাঠামোগত হয় , যা কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য - ভিত্তিক হয় না এবং যার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে একটি সম জীবনবোধ এবং সম মানসিক চেতনাসম্পন্নবোধ জাগ্রত হয় । যেমন গ্রাম্যসমাজ । 

এক কথায় সম্প্রদায় হল

 ●একটি অন্তরঙ্গ মানবগোষ্ঠী 

 ● একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ আঞ্চলিক গোষ্ঠী

 ● বিশেষ কোন অঞ্চলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কস্থাপন এবং এই অঞ্চলকে ভিত্তি করে সদস্যদের বিশেষ মনোভাব । অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি যার মধ্যে দিয়ে মানুষের সামগ্রিক সামাজিক উদ্দেশ্য , স্বার্থ , অভাব ইত্যাদি চরিতার্থ হয় ; একটি সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় থেকে শুধু আলাদাই নয় , একটি সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে অন্য কোন সম্প্রদায়ের অবস্থানও সম্ভব নয় । 

● এর গঠনে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য থাকে না ;

 ● এটি একটি স্থায়ী এবং ধারাবাহিক গোষ্ঠী , এবং 

● একটি সমজীবনবোধ এবং সমমানসিকতার চেতনাসম্পন্ন গোষ্ঠী ।

👉👉 সম্প্রদায় কত প্রকার - সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি কয়টি

 সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য

 সম্প্রদায়ের উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আমরা দেখলাম যে , কোন মানব গোষ্ঠীকে সম্প্রদায় বলে গণ্য করা যায় না । আবার আকস্মিকভাবে , স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর আবির্ভাবও ঘটে না । এর কতগুলি উপাদান আছে । তাই ভিত্তিতেই একটি জনগোষ্ঠীকে সম্প্রদায় বলে চিহ্নিত করা হয় । আলোচ্য উপাদানগুলি পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সম্প্রদায়ের কিছু বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে । যেমন— 

সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

 সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যাবলী 

১ )জনগোষ্ঠীর :   সম্প্রদায়ের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক নিবিড় । প্রকৃতপক্ষে জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের একটি অপরিহার্য অঙ্গ । বিশেষ কোন ছোট বা বড় জনগোষ্ঠী স্থায়ীভাবে একত্রিত বসবাসের মধ্য দিয়ে সম্প্রদায়ের সূচনা ঘটে । 

২ ) সুনির্দিষ্ট এলাকা : সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল । গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনধারা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক হলে তখন তা সম্প্রদায় হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে । তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের স্থান পরিবর্তন ঘটতে পারে ।

 ৩ ) নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসের ফলে সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয় যা অপরিবর্তিত অবস্থায় অবস্থান করে । ' আমরা বোধ ’ এই গোষ্ঠীর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য । 

৪ ) সমষ্টিমানসিকতা : সম্প্রদায়ের মধ্যে অবস্থিত ‘ আমরা বোধ ’ একটি বিশেষ সমষ্টিমানসিকতা সৃষ্টি করে । এই অন্তরঙ্গতার উপর ভিত্তি করে একই ধরনের জীবন বোধ , অভিন্ন আচার আচরন , খাদ্যাভাষ , ভাষা , সংস্কৃতির সূত্রপাত হয় । একে পাথেয় করে সম্প্রদায়গুলি স্বতন্ত্রতা লাভ করে ।

 ৫ ) সম্প্রদায়গুলি স্বাতন্ত্রের বিচারে এতই দৃঢ় থাকে যে একটি সম্প্রদায়ের ভেতরে অন্য কোন সম্প্রদায় থাকতে পারে না । 

৬ ) সম্প্রদায়ের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল অভিন্নতা । সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে প্রচলিত ভাষা , রীতি নীতি সংস্কৃতির প্রতি সদস্যরা এতই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে এগুলির বিরুদ্ধাচারণের সামান্য সাহসও তাদের থাকে না ।

৭ )অকৃত্রিম গোষ্ঠী জীবন  :  প্রকৃতিগত দিক থেকে সম্প্রদায় হল একটি খুব স্বাভাবিক এক অকৃত্রিম গোষ্ঠী জীবন । এটি কারো ইচ্ছাতে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে না । 

৮ )সার্বজনীন গোষ্ঠী  : সম্প্রদায় একটি ধারাবাহিক সর্বব্যাপী এবং সার্বজনীন গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত হয় । একটি সম্প্রদায় এক একটি স্বতন্ত্র নামে চিহ্নিত হয় । 

৯ ) সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বৃহৎ । সম্প্রদায় হল সদস্যদের বহুমুখী উদ্দেশ্য সাধনের স্থল । এর ভেতরে মানুষের জন্ম । এর অভ্যন্তরে মানুষের বৃদ্ধি , পরিণতি এবং পরিসমাপ্তি ঘটে ।

১০ ) সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল স্থায়িত্ব । একটি ক্ষণস্থায়ী জনগোষ্ঠী একটি সম্প্রদায় হতে পারে না । তাই একটি স্থায়ী জীবন ধারার সঙ্গে সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর । 

১১ )স্বয়ংসম্পূর্ণ :   সম্প্রদায় একটি অন্তরঙ্গ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ মানবগোষ্ঠী । সদস্যরা এর অভ্যন্তরে অনায়াসে তার সার্বিক কর্মমুখী জীবনধারা অতিবাহিত করতে পারে । 

১২ ) সম্প্রদায়ের কোন আইনগত স্বীকৃতি নেই । কোন অবয়ব নেই , কোন প্রশাসনিক মানদণ্ড নেই । এর ভিত্তি হল প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি , ধর্ম বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ এবং আদর্শসমূহ ।

 সামাজিক গুরুত্ব ( Social Significance )

সবশেষে বলতে হয় মানবসমাজে সম্প্রদায়ের গুরুত্ব অপরিসীম । সম্প্রদায়বিহীন সমাজজীবা একরকম অকল্পনীয় । মানবজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় এই সম্প্রদায়ের ভেতরে অতিবাহিত হয় । এখানেই তার জন্ম , বিকাশ এবং পরিণতি । তাছাড়া সম্প্রদায়ের প্রচলিত আদর্শসমূহ দ্বারা ব্যক্তি ( সদস্য ) শৃঙ্খলিত হয় , কর্মপ্রয়াসী হয় , সহানুভূতিশীল হয় , ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয় , সমাজের ধারাবাহিকতার সহায়ক হয় , কেননা সম্প্রদায় হল একটি ধারাবাহিক গোষ্ঠীজীবন । তাছাড়া সম্প্রদায় হল একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বয়ংক্রিয় মানব সমষ্টি । সম্প্রদায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একটি সূত্রে বাঁধে । এজন্য এর গুরুত্ব যথেষ্ট ।

🔥 আরও পড়ুন   👇👇👇

👉 আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা দাও।

👉 আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য

Post a Comment

0 Comments